নামাজ বা নামাজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রাখে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দিনে পাঁচবার করা বাধ্যতামূলক, এবং এটি কুরআনের নির্দিষ্ট আয়াত তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হয়, যা সূরা নামে পরিচিত, তারপরে দাঁড়ানো, রুকু, সেজদা করা, বসা এবং সালামের মধ্য দিয়ে শেষ হয় । প্রত্যেক নামাযের শেষ অংশ বৈঠকে করা হয় এবং এতে বিভিন্ন দোয়া বা প্রার্থনা রয়েছে যা মুসলমানরা বসে পড়ে। এই নিবন্ধে, আমরা মুসলিমরা নামাজের বৈঠকে কি পড়তে হয় সেগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন : ফজরের সুন্নাত ছুটে গেলে কখন আদায় করতে হয়
নামাজের বৈঠকে কি পড়তে হয় :
চার রকাত নামাজে দুই বার বৈঠক করতে হয়। একটা হল প্রথম বৈঠক বা দরমিয়ানী বৈঠক এবং আরেকটা হল আখেরী বৈঠক বা নামাজের শেষ বৈঠক। নামাজের বৈঠকে কি পড়তে হয় যদি বলি তাহলে নামাজের প্রথম বৈঠক শুধুমাত্র তাশাহুদ পড়তে হয়ি এবং নামাজের শেষ বৈঠক পড়তে হয় তাশাহুদ, দুরূদ-ই-ইব্রাহিম,দোয়া মাসুরা। আর দুই রাকাত বিশিষ্ট নামাজে শুধুমাত্র আখেরী বৈঠক নামাজের শেষ বৈঠক করতে হয়।
নামাজের শেষ বৈঠকের দোয়া সমূহ :
- তাশাহুদ,
- দুরূদ-ই-ইব্রাহিম,
- দোয়া মাসুরা
তাশাহহুদঃ
এটি প্রতি ওয়াক্ত নামাজের দুই রাকাত এবং চার রাকাতের পর বসে পড়তে হয়। তাশাহুদ কাকে বলে যদি জানতে চান এই আর্টিকেল পড়ে আসতে পারেন। তাশাহুদ কাকে বলে এবং তাশাহুদে বসার নিয়ম কি রকম?
আত্তাহিয়াতু বা তাশাহুদ আরবি উচ্চারণ:
التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ ، السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ، السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
আত্তাহিয়াতু বা তাশাহুদের বাংলা উচ্চারণ:
- ১ম বাংলা উচ্চারণ: আত্তাহিয়্যাতু লিল্লা-হি ওয়াসসালাওয়া-তু ওয়াততায়্যিবা-তু আসসালা-মু আলায়কা আইয়্যুহান নাবিইয়্যু ওয়ারাহমাতুল্ল-হি ওয়াবারাকা-তুহু আসসালা-মু আলায়না ওয়াআলা- ইবা-দিল্লা-হিস স-লিহীন। আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু।
- ২য় বাংলা উচ্চারণ : আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু, ওয়াত্ তাইয়িবাতু। আস্সালামু ‘আলাইকা আইয়্যুহান নাবীয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আস্সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহীন। আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশ্হাদু আননা মুহাম্মাদান আদুহু ওয়া রাসুলুহু।
আত্তাহিয়াতু বা তাশাহুদ বাংলা অর্থ :
যাবতীয় সম্মান, যাবতীয় উপাসনা ও যাবতীয় পবিত্র বিষয় আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সমৃদ্ধি সমূহ নাযিল হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের উপরে ও আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাগণের উপরে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। (বুখারী ৮৩৫, ৬২৩০, মুসলিম ৪০২, আবূ দাঊদ ৯৬৮, নাসায়ী ১২৯৮, ইবনু মাজাহ ৮৯৯, আহমাদ ৪১০১, মিশকাত ৯০৯।)
তাশাহুদ এর হাদিস
اللهِ وَبَرَكَاتُهُ السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِينَ فَإِنَّهٗ إِذَا قَالَ ذلِكَ أَصَابَ كُلَّ عَبْدٍ صَالِحٍ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلهَ اِلَّا اللّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهٗ وَرَسُوْلُهٗ ثُمَّ ليَتَخَيَّرْ مِنَ الدُّعَاءِ اَعْجَبَهٗ إِلَيْهِ فَيَدْعُوْهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমরা যখন রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে সলাত আদায় করতাম তখন এ দুআ পাঠ করতাম, “আসসালা-মু আলাল্ল-হি ক্বাবলা ইবাদিহী, আসসালা-মু আলা-জিবরীলা, আসসালা-মু আলা- মীকায়ীলা, আসসালা-মু আলা- ফুলা-নিন” – (অর্থাৎ- আল্লাহর উপর সালাম তাঁর বান্দাদের উপর পাঠাবার আগে, জিবরাঈলের উপর সালাম, মীকায়ীল-এর উপর সালাম। সালাম অমুকের উপর)। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন সলাত শেষ করলেন, আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “আল্লাহর উপর সালাম” বল না। কারণ আল্লাহ তো নিজেই সালাম (শান্তিদাতা)।
অতএব তোমাদের কেউ সলাতে বসে বলবে, “আত্তাহিয়্যাতু লিল্লা-হি ওয়াসসালাওয়া-তু ওয়াততায়্যিবা-তু আসসালা-মু আলায়কা আইয়্যুহান নাবিইয়্যু ওয়ারাহমাতুল্ল-হি ওয়াবারাকা-তুহু আসসালা-মু আলায়না ওয়াআলা- ইবা-দিল্লা-হিস স-লিহীন” (অর্থাৎ সব সম্মান, ইবাদাত, উপসানা ও পবিত্রতা আল্লাহর জন্য। হে নাবী! আপনার উপর আল্লাহর সব নেক বান্দাদের উপর সালাম)। নাবী (সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, কোন ব্যক্তি এ কথাগুলো বললে এর বারাকাত আকাশ ও মাটির প্রত্যেক নেক বান্দার কাছে পৌছবে।
এরপর নাবী (সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু”- (অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রসূল)। নাবী (সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এরপর আল্লাহর বান্দার কাছে যে দু’আ ভাল লাগে সে দু’আ পাঠ করে আল্লাহর মহান দরবারে আকুতি মিনতি জানাবে। (বুখারী ৮৩৫, ৬২৩০, মুসলিম ৪০২, আবূ দাঊদ ৯৬৮, নাসায়ী ১২৯৮, ইবনু মাজাহ ৮৯৯, আহমাদ ৪১০১, মিশকাত ৯০৯।) প্রত্যেক নামাজের বৈঠকে কি পড়তে হয় তাহল নামাযের তাশাহহুদ পাঠ কররা পর সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপর দুরূদ পাঠ করতে হয়।
দুরূদ-ই-ইব্রাহিম:
দুরূদ-ই-ইব্রাহিম একটি নির্দিষ্ট দুআ যা মুসলমানরা প্রত্যেক নামাজের শেষ তাশাহহুদে পাঠ করার পর পড়ে। যার অর্থ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর দোয়া করা। মুসলমানরা নবী (সাঃ) এর প্রতি তাদের ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতে এবং বিচার দিবসে তাঁর সুপারিশ চাইতে এই দুআ পাঠ করে।
দরুদে ইব্রাহিম আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ:
সালাতের মধ্যে দরুদে ইব্রাহিম পাঠ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। দরুদে ইব্রাহিম বেশ ফজিলতপূর্ণ। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এই দরুদ পড়া হয়। সালাত ছাড়াও অন্যান্য যেকোনো সময় এই দরুদ শরিফ পাঠে রয়েছে মুস্তাহাব সওয়াব।
দরুদে ইব্রাহিম আরবি উচ্চারণ :
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدُ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ
দরুদে ইব্রাহিম বাংলা উচ্চারণ :
আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা ইবরা-হীমা অ আলা আ-লি ইবরা-হিম, ইন্নাকাহামিদুম মাজিদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅ আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হিমা অ আলা আ-লি ইবরা-হিম, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।
দরুদে ইব্রাহিম অর্থ :
হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ ও তার বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হজরত ইব্রাহিম ও তাঁর বংশধরের উপর রহমত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত।
হে আল্লাহ! তুমি হজরত মুহাম্মদ ও তার বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হজরত ইব্রাহিম ও তার বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১২৯১)
দোয়া মাসুরা :
নামাজের শেষ বৈঠকে দোয়া মাসুরা পড়তে হয়। নামাজের বৈঠকে কি পড়তে হয় তাশাহ্হুদের পর দরুদ পড়া এবং এরপর দোয়া মাসুরা পড়া সুন্নত। দোয়া মাসুরা শেষে সালাম ফেরাতে হয়। এখানে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। বরং একটি মাসনুন দোয়া পড়লেই হয়। এমনকি একাধিক দোয়াও পড়া যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘অতঃপর (দরুদ পাঠের পর) যে দোয়া ইচ্ছে, সেটা পড়বে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪০২)
প্রত্যেক নামাজের শেষ বৈঠকের দোয়া সমূহ :
নামাজের শেষ বৈঠকের দোয়া সমূহর মধ্যে তাশাহ্হুদ, দরুদ পড়া এবং এরপর দোয়া মাসুরা ফলে অনেকেই মনে করেন দোয়া মাসুরা বলতে শুধু এটিই। অনেকেই মনে করেন এটি ছাড়া অন্য কোনো দোয়া পড়লে হবে না। আসলে বিষয়টি এমন নয়; বরং এক্ষেত্রে কোরআন-হাদিসে বর্ণিত যেকোনো দোয়া-ই পড়া যায় তবে ফরজ নামোজে কোরআন বর্ণিত দোয়া পড়া উত্তম। এতে সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ দোয়া মাসুরা
দোয়া মাসুরা আরবি উচ্চারণ:
اللهم إني ظلمت نفسي ظلما كثيرا ولا يغفر الذنوب إلا أنت فاغفرلي مغفرة من عندك وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم
দোয়া মাসুরা বাংলা উচ্চারণ :
আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান কাসিরা । ওয়ালা ইয়াগ ফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা। ফাগফির লি, মাগফিরাতাম মিন ইনদিকা; ওয়ার হামনি, ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম।
দোয়া মাসুরা অর্থ :
হে আল্লাহ! আমি নিজের উপর অনেক জুলুম করেছি। আর আপনি ছাড়া গুনাহ ক্ষমাকারী আর কেউ নেই। আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি রহম করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই ক্ষমাকারী, করুণাময়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৩৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭০৫)
উপসংহারে, নামাজ প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের একটি অপরিহার্য দিক এবং এতে দোয়া জড়িত। প্রতিটি নামাজের শেষ অংশ, শেষ বৈঠকে নামে পরিচিত, নির্দিষ্ট দুআ নিয়ে গঠিত যা একটি নির্দিষ্ট বৈঠকে বসে পড়ে।
Leave a Reply